আজ থেকে ৭১ বছর আগে কথা। রহমানিয়া হোটেল রাজশাহীর ইফতারিতে যোগ করেছিল নতুন স্বাদ। তা হলো মাটির পাত্রে শাহি ফিরনি। তখন দাম ছিল মাত্র চার আনা। এই ফিরনি এখন রাজশাহীর ইফতারির ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু রহমানিয়া নয়, এখন অন্যরাও বানাচ্ছে এই ফিরনি। হয়তো একটু আলাদা ঢঙে, একটু আলাদা দামে। তবে সেই মাটির পাত্র একই।
রহমানিয়া হোটেল এই ফিরনির ক্রেতা তৈরি করে ফেলেছে। এতে বাড়ছে চাহিদা। এ জন্য সাত দশক আগের চার আনার ফিরনির দাম এখন ৩৫ টাকা। তাঁরা বলছেন, সব জিনিসের দাম বেড়েছে। তাই এর চেয়ে কমে তাঁরা দিতে পারছেন না। তবু যাঁদের পছন্দ, তাঁরা শাহি ফিরনি কিনছেনই। শহরের চিলিস থাই অ্যান্ড চায়নিজ ফুড নামের একটি রেস্তোরাঁও কয়েক বছর ধরে তৈরি করছে এই ফিরনি। তারা বিক্রি করছে ৮০ টাকায়। তাঁরাও বলছেন, চাহিদা রয়েছে।
রাজশাহী নগরের গণকপাড়া এলাকায় অবস্থিত রহমানিয়া হোটেল। এই হোটেলের স্বত্বাধিকারী রিয়াজ আহাম্মেদ খান জানালেন, ১৯৫০ সালে তাঁর দাদা আনিছুর রহমান খান এই হোটেল করেন। দুই বছর পর ১৯৫২ সাল থেকে এখানে শাহি ফিরনি বিক্রি চালু করেন। তখন এক বাটি ফিরনির দাম ছিল চার আনা। দাদার মৃত্যুর পরে তাঁর বাবা আবদুল বারি খান এই ব্যবসার হাল ধরেন। বাবার মৃত্যুর পরে তিনি এই ব্যবসা দেখাশোনা করছেন।
কেবল পবিত্র রমজান মাসেই বানানো হয় এই ফিরনি। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই প্রতি বাটিতে ১০০ গ্রাম করে দেওয়া হতো, এখনো সেই পরিমাণ দেওয়া হয়। এত বছর পরেও আসল শাহি ফিরনির মান অটুট রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। রিয়াজ আহাম্মেদ বলেন, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় ফিরনির দাম তাঁরা এবার পাঁচ টাকা বাড়িয়ে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা করেছেন। কিছুতেই এর নিচে রাখা যাচ্ছে না। শাহি ফিরনি ছাড়াও এই হোটেলের শাহি হালিম, শামি কাবাব, কাঠি কাবাব, শিক কাবাব, পেঁয়াজু, বেগুনি, কচুরি ও জিলাপি বেশ জনপ্রিয়।
গত মঙ্গলবার বিকেলে এই হোটেলে গিয়ে দেখা যায়, ইফতারি ক্রেতাদের সামলাতে সবাই ব্যস্ত। ভিড়ের মধ্যে হিসাবের খাতা থেকে মুখ তুলে রিয়াজ আহাম্মেদের ছোট ভাই জুবায়ের আহাম্মেদ বললেন, ইফতারি ক্রেতার চাপ অন্য বছরের তুলনায় এবার একটু কম। তবে ফিরনির চাহিদাটা পড়েনি।
দাঁড়ানো বেশ কয়েকজন ক্রেতার হাতেই ফিরনির বাটি দেখা গেল। দ্রুত ইফতারি নিয়ে বাসায় ফেরার তাগিদ সবার। কথা বলার যেন কারও ফুরসত নেই। তবু ফিরনির স্বাদটা ঠিক আছে কি না, জানা দরকার। নগরের হেতেমখাঁ এলাকার বাসিন্দা শফিকুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাওয়া গেল। তিনি বললেন, ‘প্রতিবছরই তিনি ইফতারিতে শাহি ফিরনি রাখেন। ঐতিহ্যবাহী ফিরনির সেই স্বাদ তো আছেই, সেই সঙ্গে এক বছর পরে জিনিসটা পাই। তখন মনে হয় ঘ্রাণটা নতুন।’
মাটির পাত্রের এই ফিরনি যেন রাজশাহীর ইফতারির ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে। সে জন্য অন্যরাও তৈরি করছেন এই ফিরনি। শহরের সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে অবস্থিত চিলিস থাই অ্যান্ড চায়নিজ নামের একটি রেস্তোরাঁ কয়েক বছর ধরে একইভাবে মাটির পাত্রে ফিরনি তৈরি করছে। তবে তারা দাম নিচ্ছে ৮০ টাকা। এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মাসুদুর রহমান বললেন, দাম ৮০ টাকা হলেও তাঁদের ফিরনির চাহিদা আছে। কেন দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে—কারিগর আলী হোসেন তাঁর ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন, রহমানিয়া হোটেলের ৩৫ টাকার ফিরনি আর তাঁদের ৮০ টাকার ফিরনি অবশ্যই এক হবে না। তাদের সঙ্গে একটি জিনিসে মিল আছে, সেটা হচ্ছে মাটির পাত্র। আর সব উপকরণ আলাদা। রহমানিয়া মূল উপকরণ সুজি ব্যবহার করে। চিলিসে ব্যবহার করা হয় চালের গুঁড়া। সঙ্গে খেজুরের গুড়ের একটা ফ্লেভার রয়েছে। পরিমাণেও একটু বেশি দেওয়া হয়। এ জন্যই দাম বেশি।
রাজশাহী নগরের লক্ষ্মীপুর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক রাশিদা বেগম কিনেছেন চিলিসের ফিরনি। তিনি বললেন, তাঁর লন্ডনপ্রবাসী বোন চিকিৎসক রাজিয়া খাতুন দেশে এসেছেন। তাঁর জন্য তিনি এই ফিরনি কিনেছেন। রহমানিয়া হোটেলেরটা এর আগে তিনি খেয়েছেন। নতুনটা কেমন, তা দেখার জন্য কিনেছেন। তাঁর বোন খেয়ে বলেছেন, জিনিসটা ভালো।